ডায়াবেটিস মেলাইটাস হলো একটি বিপাক জনিত সমস্যা যেখানে রক্তের গ্লুকোজ স্থায়ীভাবে বেড়ে যায়। বংশগত বা/এর পারিপার্শিক কারণে ইনসুলিন নামক হরমোনের নিঃসরণ কমে গেলে বা ইনসুলিনের ক্ষমতা কমে গেলে বা এ দুয়ের মিলিত প্রভাবে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়।
আমরা যে খাদ্য গ্রহণ করি তা বিভিন্ন ছোট ছোট সরল উপাদানে পরিবর্তীত হয়, যার একটি হলো গ্লুকোজ। গ্লুকোজ প্রধানত শর্করা জাতীয় খাবার থেকে আসে এবং রক্তের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন কোষে বাহিত হয়। কোষের শক্তি উৎপাদনের জন্য গ্লুকোজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানবদেহের অগ্ন্যাশয় নামক গ্রন্থির বিটা কোষ থেকে তৈরী হওয়া হরমোন ইনসুলিন, রক্তের গ্লুকোজ ব্যবহারে সহায়তা করে। ডায়াবেটিস হলে ইনসুলিনের নিঃসরণ কমে যায় অথবা ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা কমে যায় অথবা এ দুটোর মিলিত প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ফলে শরীর গ্লুকোজ ঠিকমত ব্যবহার করতে পারে না এবং রক্তের গ্লুকোজ বেড়ে যায় এই অবস্থাই ডায়াবেটিস মেলাইটাস। রক্তের গ্লুকোজ অতিরিক্ত বেড়ে গেলে এক পর্যায়ে অতিরিক্ত গ্লুকোজের একাংশ প্রস্রাবের সাথে বেরিয়ে আসে। রক্তের গ্লুকোজের এই অতিরিক্ত অবস্থা সময়মত ও ঠিকমত চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন চোখ, কিডনী, হৃদযন্ত্র, স্নায়ুতন্ত্র ইত্যাদিতে বিভিন্ন ধরণের দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
প্রকারভেদ
ডায়াবেটিস মেলাইটাসকে নিম্নের বিভিন্ন প্রকারে ভাগ করা যায়:
টাইপ-১ ডায়াবেটিস
টাইপ-২ ডায়াবেটিস
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস মেলাইটাস
অন্যান্য বিশেষ ধরণের ডায়াবেটিস
টাইপ-১ ডায়াবেটিস
সাধারণত ৩০ বৎসরের কম বয়সীদের টাইপ-১ ডায়াবেটিস হলেও যেকোন বয়সের লোকই এ ধরণের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে। বিশ্বের মোট ডায়াবেটিক জনগোষ্ঠীর ৫-১০% এ ধরণের ডায়াবেটিসে ভোগে। টাইপ-১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে শরীরের আভ্যন্তরীন কিছু সমস্যার কারণে অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন প্রস্তুতকারী বিটা কোষগুলো ধ্বংস হয়ে যায় ফলে ইনসুলিন একেবারেই তৈরি হয় না। আর তাই বেঁচে থাকার জন্য এদের ইনসুলিন দেয়া অত্যাবশ্যক। তাছাড়া এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ডায়াবেটিসের উপসর্গ দেখা দেয়। টাইপ-১ ডায়াবেটিক ব্যক্তিদের ওজন সাধারণত কম হয়ে থাকে।
টাইপ-২ ডায়াবেটিস
আমাদের দেশের বেশিরভাগ ডায়াবেটিক ব্যক্তিই টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। এদের শরীরে ইনসুলিনের আপেক্ষিক অভাবের পাশাপাশি ইনসুলিন ঠিকমত কাজ করতে না পারা (Insulin Resistance) উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। সাধারণত ৩০ বৎসরের অধিক বয়সী ব্যক্তিদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস হয়ে থাকলেও কখনও কখনও অল্প বয়সেও হতে পারে। এদের রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রক্রিয়া কিছুটা মন্থর হওয়ায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উপসর্গগুলো সঠিক ভাবে প্রকাশ পায় না। টাইপ-২ ডায়াবেটিক ব্যক্তিদের ওজন সাধারণত স্বাভাবিক বা বেশি হয়ে থাকে। চিকিৎসা হিসেবে টাইপ-২ ডায়াবেটিক ব্যক্তিদের জীবন যাত্রায় পরিবর্তন, ওজন স্বাভাবিক মাত্রার ভিতর রাখা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
অন্যান্য বিশেষ ধরণের ডায়াবেটিস
কখনো কখনো কোন নির্দিষ্ট ঔষধ দীর্ঘদিন খাওয়ার ফলে অথবা কোন হরমোন জনিত সমস্যার কারণে রক্তের গ্লুকোজ বেড়ে যায়। এ ধরণের ডায়াবেটিস এর ভিতর উল্লেখযোগ্য হলো-
হরমোন রোগ – Cushing’s Syndrome, Thyrotoxicosis, Acromegaly ইত্যাদি।
ঔষধ -ষ্টেরয়েড জাতীয়
অগ্ন্যাশয়ের রোগ – FCPD, অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ ইত্যাদি।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস
গর্ভকালীন সময়ে মহিলাদের রক্তের গ্লুকোজ বেড়ে গেলে সে অবস্থাকে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বলে। এ সময় ডায়াবেটিস খুব ভালো নিয়ন্ত্রণে রাখা মা এবং গর্ভস্থ শিশুর সুস্থ্য বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় ডায়াবেটিসের চিকিৎসা হিসেবে ইনসুলিনই একমাত্র উপায়। তাছাড়া পরবর্তীতে এ সকল মহিলার টাইপ-২ ডায়াবেটিস হবার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায় বলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত পরীক্ষা নিরীক্ষা করা প্রয়োজন।
ডায়াবেটিস ও এর উপসর্গ
ডায়াবেটিস এর উপসর্গগুলোকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
১। ডায়াবেটিসের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত (Typical)
বেশি বেশি প্রস্রাব হওয়া
বেশি বেশি পিপাসা পাওয়া
বেশি বেশি ক্ষুধা লাগা
ওজন কমে যাওয়া
দূর্বল হয়ে যাওয়া
২। ডায়াবেটিসের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত নয় (Atypical)
অকারণ দূর্বলতা
ঘা না শুকানো
বার বার গর্ভপাত হওয়া
সন্তান না হওয়া
বার বার প্রস্রাবে ইনফেকশন হওয়া
চুলকানি হওয়া ইত্যাদি
৩। ডায়াবেটিসের জটিলতা সমূহ
চোখের সমস্যা
স্নায়ুবিক সমস্যা ইত্যাদি
৪। উপসর্গ ছাড়া
বেশির ভাগ টাইপ-২ ডায়াবেটিক ব্যক্তির কোন রকম উপসর্গ থাকে না এবং সাধারণত অন্য কোন কারণে রক্ত পরীক্ষায় ডায়াবেটিস ধরা পড়ে।
ডায়াবেটিস নির্ণয়ের উপায়
Oral Glucose Tolerance Test (OGTT)
ডায়াবেটিস নির্ণয়ের আদর্শ পরীক্ষা। OGTT করার জন্য অন্তত ৩ দিন স্বাভাবিক শর্করাসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পর সারারাত না খেয়ে এবং পূর্ণবিশ্রাম শেষে সকাল বেলা খালি পেটে রক্তের গ্লুকোজ (FBG) পরীক্ষা করা হয়। অত:পর প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির ক্ষেত্রে ২৫০-৩০০ মি.লি. পানিতে ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ মিশিয়ে ৫ মিনিট সময়ের ভিতর খাওয়ানো হয়। গ্লুকোজের শরবৎ খাওয়ানোর ২ ঘণ্টা পর পুনরায় রক্তের গ্লুকোজ (2hr AG) পরীক্ষা করা হয়। OGTT রিপোর্টে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রার উপর একজন ব্যক্তিকে Normal, IFG, IGT বা DM হিসেবে সনাক্ত হয়ে থাকে।
Fasting Blood Glucose (FBG) সাধারণত (৮-১৪ ঘণ্টা) অভুক্ত থেকে সকালে খালি পেটে রক্তে গ্লুকোজ (FBG) পরীক্ষা করে কখনো কখনো একজন ব্যক্তির ডায়াবেটিস আছে কিনা নিশ্চিত (৭ বা ৭ এর বেশি হলে) করা গেলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস নাই এটা বলার সুযোগ থাকে না এবং সে সব ক্ষেত্রে OGTT এর মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হয়।
Random Blood Glucose (RBG)
দিনের যে কোন সময় রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা (RBG) অনুযায়ী একজন ব্যক্তির ডায়াবেটিস আছে কি নাই সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই OGTT এর মাধ্যমে ডায়াগনোসিস নিশ্চিত করা জরুরী।
ডায়াবেটিসের পূর্বাবস্থা (Pre-diabetes)
এ সকল ব্যক্তির রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কিন্তু ডায়াবেটিসের নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে কম থাকে। IFG এবং IGT এই শ্রেণীভুক্ত। পরবর্তী সময়ে এদের ডায়াবেটিস হবার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধ
ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা সারাবিশ্বে দিন দিন বেড়েই চলেছে। আর এর কারণ হিসেবে জনসংখ্যার গড় আয়ু বৃদ্ধির পাশাপাশি অলস জীবন যাপন, অতিরিক্ত চর্বি ও শর্করা যুক্ত খাবার গ্রহণ, স্থুলতার হার বৃদ্ধি এবং ক্রমবর্ধমান নগরায়ন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। ডায়াবেটিক ব্যক্তির সংখ্যা বাড়ার সাথে ডায়াবেটিস জনিত নানাবিধ সমস্যা/জটিলতাও ক্রমশ: বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বে প্রতি ২৪ ঘণ্টায়
৩৬০০ জন নতুন ডায়াবেটিক সনাক্ত হয়
৫৮০ জন ডায়াবেটিস সম্পর্কিত জটিলতায় মারা যায়
২২৫ জনের ডায়াবেটিস জনিত কারণে নিম্নাঙ্গ কেটে ফেলা হয়
১২০ জন ডায়াবেটিক রোগীর মারাত্মক কিডনী রোগ হয়
৫৫ জন ডায়াবেটিক রোগী অন্ধ হয়ে যায়
Primary Prevention (প্রাথমিক প্রতিরোধ):
১। সাধারণ জনগোষ্ঠীর ডায়াবেটিস প্রতিরোধঃ এক্ষেত্রে একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীকে সামনে রেখে তাদের স্বাস্থ্য পরিচর্যায় কিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হয় যা ডায়াবেটিসের পাশাপাশি উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ এবং অন্যান্য অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে সমান সহায়ক। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগগুলো হলো:
সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা:
জাতীয় এবং বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থাকে সাহায্য করা
প্রতিরোধের অর্থনৈতিক উপকারিতা সম্পর্কে জন সাধারণকে অবহিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা
বেসরকারী উদ্যোগ:
কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা
স্বাস্থ্যকর খাদ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করা
সামাজিক সহায়তা:
পুষ্টি/স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস/ব্যায়াম ইত্যাদি বিষয়ে স্কুল থেকেই সময়োপযোগী শিক্ষা প্রদান করা
নগর পরিকল্পনার সময় স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ব্যায়াম করার পর্যাপ্ত সুযোগ এবং স্বাস্থ্যসম্মত নগরায়ন নিশ্চিত করা
সাধারণ জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় খেলাধুলার ব্যবস্থা করা
প্রচার মাধ্যম:
জনসাধারণের পরিচ্ছন্ন শিক্ষা ও ধারণা প্রদানের মাধ্যমে তাদের উদ্বুদ্ধ করা। এ কাজে সংবাদপত্র, টিভি, রেডিও ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা পালন করতে পারে।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্য দৈনন্দিন জীবনধারার যে সকল বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে সেগুলো হলো:
প্রতিদিন অন্তত: ৩০ মিনিট মাঝারী ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম করতে উৎসাহিত করা
প্রত্যেক ব্যক্তিকে আদর্শ ওজন ধরে রাখতে উৎসাহিত করা
যাদের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তাদের অন্তত: ৫-১০% ওজন কমানোর চেষ্টা করা
অপ্রাপ্ত বয়স্কদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে আদর্শ উচ্চতা ও আদর্শ ওজন লাভ নিশ্চিত করা
২. উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর ডায়াবেটিস প্রতিরোধঃ এক্ষেত্রে ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞের পরামর্শক্রমে জীবন-যাপন উন্নয়ন করে প্রয়োজনীয় ওষুধ গ্রহণ করতে হবে।
ডা: শাহজাদা সেলিম
এমবিবিএস, এমডি (এন্ডোক্রাইনোলজি), এমএসিই (ইউএসএ)
সহকারী অধ্যাপক
এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ
ইমেইল: selimshahjada@gmail.com