
বিশ্বজুড়েই ডায়াবেটিস এক নীরব ঘাতক, এক মহামারি অবস্থা। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ব্যপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে এ রোগী রয়েছে প্রায় ৯০ লক্ষ, দিন দিন এ রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। অনুমান করা হয় ২০৪০ সাল নাগাদ বাংলাদেশেই এই রোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ১ কোটি ২০ লক্ষ। আর সারা বিশ্বে এ সংখ্যা আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ৫৫ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। কেবলমাত্র সচেতনতার অভাবেই এই বিপুল সংখ্যক মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। একটু সচেতন হয়ে সুশৃঙ্খল জীবন-যাপন করলে এই বৃদ্ধির হার কমানো সম্ভব।
একটা সময় ছিল, যখন মনে করা হতো ডায়াবেটিস চল্লিশের পরে হয়। বর্তমানে সব বয়সের মানুষই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। এমনকি হরমোন সংশ্লিষ্ট এই রোগটির প্রকোপ শহর ছাড়িয়ে এখন গ্রামেও বেড়ে চলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা বৈশ্বিক পরিবর্তনের ফলাফল। দ্রুত নগরায়ন এর প্রধান কারণ। তাই জনসচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।
স্বাভাবিকের চেয়ে রক্তে বেশি শর্করা বা সুগার থাকলে তাকে বলা হয় ডায়াবেটিস মেলাইটাস বা সংক্ষেপে ডায়াবেটিস। শরীরে ইনসুলিন নামক হরমোনের ঘাটতিতে তৈরি বিপাকজনিত সমস্যা এটি। বাংলায় এই রোগকে আমরা মধুমেহ বলেও জানি। এই সমস্যার মূল কারণ আমাদের অযাচিত লাইফস্টাইল বা জীবনযাপন পদ্বতি। যে বয়সে আমাদের যতটুকু খাদ্য খাওয়া উচিৎ, আমাদের বেড়ে ওঠা, বেঁচে থাকা এবং নিত্যদিনকার প্রয়োজনীয় শক্তি সঞ্চয়ের জন্য এবং তারপর সেই খাদ্য বিপাকের জন্য যতটুকু শারীরিক পরিশ্রম আমাদের করা উচিৎ সেগুলো না করার জন্যই মূলত এই সমস্যা। এছাড়াও কারো কারো পারিবারিক ইতিহাস এই সমস্যার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়।
লাইফস্টাইল বা জীবনযাপনের সঠিক পদ্বতি সম্পর্কে আমাদের স্বচ্ছ ধারণার অভাব থাকায় আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় খাবার বা সুষম খাবার খেতে পারছি না এবং সে অনুযায়ী শারীরিক পরিশ্রমও করছি না। বরং খাবারের ক্ষেত্রে আমরা পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য অনুসরণ করার চেষ্টা করছি। ফল দাড়াচ্ছে, আমরা গ্রহণ করছি বেশি বেশি এবং সে অনুযায়ী খরচ করছি না। এর পুরো দায়ভার গিয়ে পড়ছে আমাদের শরীরের বিপাক প্রক্রিয়ার উপর। আর এ কারণেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার বয়স দিনে দিনে কমে আসছে। এই ধরণের ডায়াবেটিসকে আমরা বলি টাইপ-টু ডায়াবেটিস। এই ডায়াবেটিসে আক্রান্তরা এক সময় পুরোপুরি সুস্থ্য ছিল। লাইফস্টাইল বা জীবনযাপন পদ্বতি ঠিকঠাক না মেনে চলার কারণে কিছু সময় পর ডায়াবেটিস চলে আসলো বর্ডার লাইনে, তারপর অল্প ডায়াবেটিস এবং নানা ধাপ পার হয়ে একসময়ে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস।
অন্যদিকে টাইপ-ওয়ান বলে আর এক ধরণের ডায়াবেটিস খুব অল্প বয়সেই ধরা পড়ে। এক্ষেত্রে কোনো এক কারণে তাদের শরীরের অগ্নাশয় থেকে একদমই কোনো ইনসুলিন তৈরী হয় না। আমি মনে করি, এই একটি দিক দিয়ে কিছুটা হলেও আমরা সুবিধাজনক অবস্থায় আছি। আমাদের এ হার শতকরা ৫ ভাগের বেশি না যেখানে কোন কোন উন্নত দেশে প্রায় ৩৫ ভাগেরও বেশি।
টাইপ-ওয়ান কিংবা টাইপ-টু যে ধরনের ডায়াবেটিসই হোক না কেন, সুশৃঙ্খল জীবন-যাপন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একে শতভাগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় তবে ভালো হবে না কখনো। নিয়ন্ত্রণে রাখার সুবিধা হলো রোগ থাকবে রোগের জায়গায়, কোনো জটিলতা হবে না। জটিলতা মানে ডায়াবেটিস সৃষ্ট হার্টের রোগ, স্ট্রোক, অন্ধত্ব, কিডনি বিকল হয়ে যাওয়া, পঙ্গুত্ব সহ নানা জটিলতা। হয় না এমন কোনো জটিলতা নেই যেহেতু ডায়াবেটিস রোগটি রক্তের সাথে জড়িত। অনেক ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রেখে ডায়াবেটিস রোগী সুস্থ মানুষের চেয়েও ভালো থাকে। কারণ, তিনি সবসময় জীবনযাপন পদ্বতি ঠিক ঠিক মেনে চলেন এবং নিয়মিত চিকিৎসকের সান্নিধ্যে থাকেন। অন্যদিকে টাইপ-টু ডায়াবেটিস ৭০-৮০ ভাগ প্রতিরোধযোগ্য। সম্ভাবনা যাই থাকুক না কেন, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম এবং খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ (যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই খাওয়া) করেই এ লক্ষ্য অর্জন করা যায়। প্রয়োজন এ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করা। ডায়াবেটিস সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি দীর্ঘদিন ধরে নানামূখী উদ্যোগ নিয়ে আসছে, এসব উদ্যোগের পাশাপাশি দেশের গণমাধ্যমসহ অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানকে আরো বেশি এগিয়ে আসতে হবে।
ডায়াবেটিসের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা বলতে বোঝায়, সঠিক-সুষম খাদ্য গ্রহণ ও নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে শরীরের ওজন, রক্তের চর্বির মাত্রা ও চাপ এবং রক্তের সুগার কাংখিত মাত্রার মধ্যে রাখতে হবে। শরীরের ওজন, রক্তের চর্বির মাত্রা ও চাপ নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা তা বোঝার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত পরীক্ষাগুলো করতে হয়। তবে রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা তা বোঝার জন্য নিজে নিজেই ঘরে বসে পরীক্ষা করতে হবে। প্রতিদিন না পারলেও অন্তত একদিন পর পর সকালবেলা খালি পেটে রক্তের সুগার পরীক্ষা করতে হবে। দেখতে হবে তা ৬ মিলিমোল/লি. বা ১০০ মিলিগ্রাম/ডিএল আছে কিনা। আর সপ্তাহে অন্তত একদিন সকালে খালিপেটে, নাস্তার ২ ঘন্টা পর, দুপুরের খাবারের ২ ঘন্টা পর এবং রাতের খাবারের ২ ঘন্টা পর রক্তের সুগার মাপতে হবে। দেখতে হবে খাবারের ২ ঘন্টা পর যেন ৮ মিলিমোল/লি বা ১৪০ মিলিগ্রাম/ডিএল থাকে। কোথাও এর কোন ব্যতিক্রম হলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
তবে মনে রাখতে হবে, চিকিৎসক শুধু আপনাকে গাইড করবে, নিয়মিত আপনার রক্তের সুগার আপনাকেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। কারণ চিকিৎসকের অপ্রতুলতা থাকায় প্রতিদিন তাকে পাবেন না, কিংবা আপনি প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতেও পারবেন না। কাজেই এটা যেহেত প্রতিদিনের কিংবা প্রতিবেলার ব্যবস্থাপনা, তাই এ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে। তবে যতক্ষণ আপনি না বুঝে উঠবেন ও আত্মনির্ভরশীল না হবেন ততক্ষণ আমরা আছি আপনার পাশে।
অধ্যাপক মো: ফারুক পাঠান
অধ্যাপক, হরমোন বিভাগ, বারডেম