গল্পে গল্পে ডায়াবেটিস

গল্পে গল্পে ডায়াবেটিস


ডায়াবেটিস মানে রক্তে সুগার বেশি। কী সমস্যা হয় রক্তে সুগার বেড়ে গেলে? আর কেনইবা এই সুগার বাড়ে? কোথা থেকে আসে এই সুগার? সুস্থ মানুষের রক্তে এই অতিরিক্ত সুগার থাকে না কেন?

আমাদের শরীর কোটি কোটি কোষ দিয়ে তৈরী এবং স্বাভাবিক কাজকর্মের জন্য, প্রত্যেকটি কোষেরই খাবার প্রয়োজন হয়। আমরা মুখে যা-ই খাই না কেন, হজম হয়ে সেগুলো এই সুগার তৈরী করে যা সকল কোষের জন্যই আদর্শ খাবার। কিন্তু কোষগুলোর দেয়াল চর্বি দিয়ে তৈরী, আর চিনি তো তেলে মেশানো যায়না। সুতরাং ব্যতিক্রমী কিছু কোষ ছাড়া বেশীরভাগ কোষই রক্ত থেকে সরাসরি তাদের খাবার এই সুগারকে গ্রহণ করতে পারেনা। কোষগুলোর দেয়ালে একটি দরজা থাকে যেটা লক করা থাকে। ইনসুলিন হলো সেই লকের চাবি। ইনসুলিন এসে দরজা খুলে দিলেই কেবল কোষগুলোতে রক্ত থেকে তাদের প্রয়োজনীয় সুগার প্রবেশ করে। ফলে কোষগুলোও খাবার পায়, আবার রক্তেও অতিরিক্ত সুগারের জটলা থাকে না।

রাস্তার জ্যামের কথা চিন্তা করুন। কখন জ্যাম লাগে? যখন গাড়ীগুলো তাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনা এবং সব রাস্তাতেই আটকে থাকে, সেটাই তো জ্যাম! একইরকম ভাবে ডায়াবেটিস হলো রক্তে সুগারের জ্যাম। কেননা সুগারগুলো তাদের গন্তব্য “কোষে” পৌঁছাতে পারছে না।


রক্তে বেশি সুগার থাকা মানেই হলো, আমাদের শরীরের কোষগুলো তাদের খাবার ঠিকমতো নিতে পারছেনা এবং তারা ক্ষুধার্ত থাকছে। সুতরাং শরীরে দূর্বলতা বোধ হয় এবং কোষগুলোর ক্ষুধার হাহাকারে মস্তিস্ক “পেটের ক্ষুধা” আরো বাড়িয়ে দেয়, ফলে রোগী বেশী খায়। কিন্তু সেই অতিরিক্ত খাবার থেকে তৈরী হওয়া সুগারগুলো কেবল রক্তে সুগারের জটলাই বাড়ায়, কোষের ক্ষুধা মেটায় না।

আরেকটু গভীরভাবে চিন্তা করি। কখন আপনি একটি দরজার লক খুলতে পারবেন না? ১) যখন চাবি হারিয়ে গেছে ২) চাবি আছে, কিন্তু সেটা আঁকা বাঁকা হয়ে গেছে বলে তালা খুলছে না ৩) তালার চাবি ঢোকানোর মুখটি কোন কিছু দিয়ে আটকে আছে, যে কারণে আপনি চাবিই ঢোকাতে পারছেন না।

ডায়াবেটিস রোগীদের একই সাথে তিনটি সমস্যা থাকে। ইনসুলিনের অভাব, ইনসুলিন রেজিষ্ট্যান্স এবং ইনসুলিন রিসেপ্টর ব্লক। তাই ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় বিভিন্ন প্রকারের ওষুধ এবং ইনসুলিন একসঙ্গে ব্যবহার করতে হয়, রোগীর শরীরের ভেতরের অবস্থা অনুধাবন করে।


আচ্ছা, যদি মাসের পর মাস রক্তের সুগার বেশিই থেকে যায় তাতে কি সমস্যা? পানি থেকে শরবত তো কিছুটা ঘন তাইনা? তাহলে বেশী সুগার, রক্তের ঘনত্বকেও কিছুটা বাড়িয়ে দেবে। আমাদের শরীরে এমন সূক্ষ্ম শিরা উপশিরাও আছে, যেগুলোকে খালি চোখে দেখা যায়না। এইসব সূক্ষ্ম রক্তনালী দিয়ে দিনে গড়ে এক লক্ষ পনের হাজার বার রক্ত চলাচল করে, আর মাসে প্রায় সাড়ে চৌত্রিশ লক্ষ বার! আমাদের পানির লাইনে যদি একমাস ধরে টানা ময়লা পানি আসে তাহলে মোটা পাইপের ভেতরেও আস্তরণ পড়ে, ব্ল­ক হয়। তাহলে ভেবে দেখুন, আমাদের দেহের অতি সূক্ষ্ম রক্তনালীগুলোর কি অবস্থা হতে পারে? সেগুলো ব্লক হওয়া শুরু হয় এবং যেই কোষগুলোকে তারা রক্তের মাধ্যমে পুষ্টি এবং অক্সিজেন সরবরাহ করে আসছিল সেগুলো আস্তে আস্তে মরে যেতে শুরু করে। এজন্যই মস্তিষ্ক, চোঁখ, কিডনী, নার্ভ, হার্ট ইত্যাদির ক্ষয় শুরু হয়।


এবার আবার একটু পেছনে ফিরে যাই। যাদের ডায়াবেটিস অনেক বেশি অর্থাৎ যাদের কোষগুলো খুব বেশি ক্ষুধার্ত থাকে তাদের শরীরের কোষ মরে যেয়ে কোন জায়গায় পচন ধরেনা কেন? কারণ, কোষগুলো তখন নিজ দেহের চর্বি খেয়ে (পুড়িয়ে) বেঁচে থাকে। যেহেতু তাদের দেয়ালও চর্বি দিয়ে তৈরী তাই চর্বি কোষে প্রবেশ করতে কোন সমস্যাও হয়না। কিন্তু এক্ষেত্রে বিপদ হয় অন্য। শরীর ভেঙ্গে পড়তে থাকে, ওজন কমতে থাকে, ত্বকের কমনীয়তাও নষ্ট হয়ে যায় এবং রক্তে বিষাক্ত কেমিক্যাল জমতে থাকে।

আপনাকে একটা হোমওয়ার্ক দিই। গ্যাসের চুলার উপর এক টুকরা গরু বা খাসির চর্বি পোড়ান তো! দেখবেন, সারা বাড়ি উৎকট দূর্গন্ধে ভরে গেছে। কারণ চর্বি পোড়ালে বিষাক্ত কিছু কেমিক্যাল তৈরী হয়। সুতরাং উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিস রোগী যাদের কোষগুলোকে, শরীরকে খেয়েই বেঁচে থাকতে হচ্ছে, তাদের রক্তে প্রতিনিয়ত বিষাক্ত কেমিক্যালও জমা হচ্ছে, যা কখনো কখনো মানুষটিকে মৃত্যুর মুখোমুখিও নিয়ে যেতে পারে।


আর রক্তের ওই অতিরিক্ত সুগার দীর্ঘসময় ধরে থাকলে আমাদের সব ভাইটাল অর্গান যেমন, ব্রেন, কিডনী, চোখ, নার্ভ, হার্ট ইত্যাদি নষ্ট হয়ে যাবে। এই অবস্থা থেকে বাঁচানোর জন্য ব্রেন কি কিছুই করেনা? হ্যাঁ, করে। সেটা হল প্রস্রাবের সাথে যতটা সম্ভব রক্তের সুগার বের করে দেয়। কিন্তু সুগার আবার পানিকে খুব ভালোবাসে। তাই একটি সুগার বের হয়ে যাবার সময় কয়েকটি পানিকেও সঙ্গে করে নিয়ে যায়। ফলে শরীরে পানির সংকট দেখা দেয়, গলা শুকিয়ে যায়, রোগীর ঘন ঘন পিপাসা পায়। পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করলে এই পানিশূন্যতা মৃত্যুও ডেকে আনতে পারে।


অন্য যেকোন রোগের চেয়ে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা সম্পূর্ণ আলাদা। রোগীর বয়স, পেশা, ওজন, লিঙ্গ, জীবন ধারন পদ্ধতি, সামাজিক অবস্থান, খাদ্যাভ্যাস, অন্যান্য অসুখের উপস্থিতি ইত্যাদি বহু বিষয়ের উপর ডায়াবেটিসের সঠিক চিকিৎসা নির্ভর করে। এজন্যই একই ওষুধ বা ইনসুলিনের একই ডোজ বিভিন্ন রোগীর শরীরে বিভিন্ন মাত্রার ফলাফল প্রদর্শন করে। আবার একই চিকিৎসা একই রোগীর ক্ষেত্রে বেশিদিন একই ফলাফল বজায় রাখতেও পারেনা। সুতরাং নির্দিষ্ট সময় পরপর চিকিৎসা modify বা adjust করতে হয়।


এবার আসি আমাদের দেশে। ডায়াবেটিসের প্রচলিত চিকিৎসা প্রসঙ্গে। একজন রোগী ২/৩ মাসে একবার ডায়াবেটিস সেন্টারগুলোতে যান এবং তাদের মাত্র ১ দিনের সকালের ১টি বা ২টি সুগারের মাত্রার উপর ভিত্তি করে পরবর্তী ২/৩ মাসের চিকিৎসা দেয়া হয়। অনেক রোগীই এই রক্ত পরীক্ষা উপলক্ষ্যে তার আগের ২-৩ দিন খুব নিয়ম মেনে চলেন, বেশী হাঁটাহাটি করেন এবং খাবারেও নিয়ন্ত্রন আনেন যেন রিপোর্ট ভালো আসে। আবার উল্টোটাও ঘটে। অনেকে পরীক্ষা করার দিন ওষুধ খেতে ভুলে যান বা আনতে ভুলে যান বলে আর খান না। ফলে ওষুধবিহীন সেই ত্রুটিপূর্ণ রিপোর্টের উপর ভিত্তি করেই ঠিক হয় তাদের পরবর্তী চিকিৎসা।

এখানে চিন্তা করার বিষয়গুলো হচ্ছেঃ

১) শুধু সকালে সুগার নিয়ন্ত্রণে রেখে দুপুরে এবং রাতে অনিয়ন্ত্রিত থাকলে চিকিৎসা কতখানি সুফল বয়ে আনছে আপনার জন্য? উপরের আলোচনার ভিত্তিতে একটু চিন্তা করুন-

২) নিজেকে ফাঁকি বা ডাক্তারকে ফাঁকি দেবার পরিণাম কাকে ভোগ করতে হবে?

৩) আপনার ডাক্তার কি আপনার সব দিক বিবেচনায় এনে আপনার চিকিৎসা দিচ্ছেন? যেমন, আপনার পেশা কি? আপনি কী জাতীয় খাবার খান? আপনি কীভাবে জীবন যাপন করেন? আপনার টেনশন কেমন? অন্য আর কি কি রোগে আপনি ভুগছেন? ইত্যাদি। এছাড়া আপনার ২৪ ঘন্টা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে উনি কি সচেতন?


আমি গত ১৪ বছর যাবৎ শুধু ডায়াবেটিস নিয়েই কাজ করেছি এবং অসীম কৌতূহল নিয়ে বিভিন্ন রোগীর শরীরে ইনসুলিন/ওষুধের ফলাফল বিশ্লেষণ করেছি। দীর্ঘদিন ধরে উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিসে ভুগতে থাকা অনেক জটিল রোগীদেরকেও আল্লাহর রহমতে স্বাচ্ছন্দপূর্ণ জীবন উপহার দিতে পেরেছি। এছাড়া আমার রোগীদেরকে ডায়াবেটিসের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সমূহও যত্নসহকারে শিখিয়েছি।

কিন্তু আমার কাছে এখনো প্রতিটি ডায়াবেটিস রোগীই একেকটি রহস্য উপন্যাস। আর সেই রহস্য ভেদ করে তাদেরকে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারার আনন্দটা একেবারেই অন্যরকম। এই আনন্দই আমার বেঁচে থাকার অন্যরকম অনুপ্রেরণা।

“ডায়াবেটিস রাখুন নিয়ন্ত্রণে
সুস্থ থাকুন দেহ মনে”


ডা. মোঃ এজাজ বারী চৌধুরী
ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ
সিটি হাসপাতাল লিঃ, লালমাটিয়া, ঢাকা

সাহায্য দরকার? ফোন করুন

নীচে আমাদের প্রতিনিধিদের নামের উপর ক্লিক করুন

হেল্পলাইন
হেল্পলাইন

কংগ্রেসিয়া

I am online

I am offline

আরাফাত রহমান
আরাফাত রহমান

মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ

I am online

I am offline

Scroll to Top